পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের সবচেয়ে বিস্তৃত ও জটিল এলাকা। তিনটি জেলা—খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবান—মোট ২৬টি উপজেলা, আয়তন প্রায় ১৩,০০০ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা প্রায় ১৮ লাখের বেশি। অথচ সংসদীয় আসন মাত্র ৩টি। এই বাস্তবতা থেকে নাগরিক সমাজ সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে, আসন ৩ থেকে বাড়িয়ে ৮ করতে হবে।
কিন্তু এখানে শাসন আলাদা। এখানে আদিবাসী বাঙালী সমস্যা বিরাজমান। এখানে রয়েছে সরকার এবং আদিবাসীদের মধ্যে চুক্তি। এই আসন বৃদ্ধির জন্য পার্বত্য চুক্তিতে কিছুই লেখা নেই। পার্বত্য চুক্তির যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সেটলার সংগঠনগুলো বললে তো আর হবে না। কারন পার্বত্য চট্টগ্রাম সেটলার চালায় না। এটা আদিবাসীরা চালায়। এখানে আদিবাসীদের এলাকা এবং আদিবাসীদের শাসন চলে।
পার্বত্য পরিষদ কি বলে তা আগে দেখতে হবে।
খবর অনুসারে কিভাবে আসন বৃদ্ধি করতে চাই দেখি।
খাগড়াছড়ি জেলা (মোট ৩ আসনের প্রস্তাব)
খাগড়াছড়ি জেলায় মোট ৯টি উপজেলা রয়েছে।
- খাগড়াছড়ি-১: রামগড়, মানিকছড়ি, লক্ষীছড়ি, গুঁইমারা
- খাগড়াছড়ি-২: মাটিরাঙ্গা, মহালছড়ি, পানছড়ি
- খাগড়াছড়ি-৩: খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা
রাঙামাটি জেলা (মোট ৩ আসনের প্রস্তাব)
রাঙামাটি জেলায় মোট ১০টি উপজেলা রয়েছে।
- রাঙামাটি-১: বাঘাইছড়ি, লংগদু, বরকল
- রাঙামাটি-২: রাঙামাটি সদর, কাউখালি, নানিয়ারচর
- রাঙামাটি-৩: জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, রাজস্থলী
বান্দরবান জেলা (মোট ২ আসনের প্রস্তাব)
বান্দরবান জেলায় মোট ৭টি উপজেলা রয়েছে।
- বান্দরবান-১: বান্দরবান সদর, রুমা, থানছি, বোয়াংছড়ি
- বান্দরবান-২: লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি
প্রতিটি আসনের অধীনে উপজেলার নামও উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তি দেখানো হচ্ছে যে এত বড় ভৌগোলিক এলাকায় একজন এমপির পক্ষে জনগণের চাহিদা দেখা সম্ভব নয়। সাজেকের আয়তন ঢাকার চেয়েও বেশি, অথচ রাঙামাটিতে একটি আসন; ঢাকায় ২০। এই বৈপরীত্য অস্বীকার করার উপায় নেই।
এটা কি শুধুই উন্নয়ন নাকি অন্য কিছু?
আপনার ইনপুটে এসেছে, সেনারা এবং প্রশাসন সবসময় পাহাড়ি এলাকাকে নিরাপত্তার চশমায় দেখে। স্মারকলিপিতে “৭টি সশস্ত্র সংগঠন,” “প্রতিবেশি দেশের মদদ,” “শান্তি ফিরবে না” ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হয়েছে।
এগুলো কি কেবল নিরাপত্তা যুক্তি, নাকি ভবিষ্যতের কোনো রাজনৈতিক নকশা?
উপজেলাভিত্তিক জনসংখ্যার তথ্য বলছে আদিবাসী বিরূপ কিছু। যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আগে ছিল ৯৮.৫% আদিবাসী, এখন তা হচ্ছে ৪০%।
চলুন দেখি।
খাগড়াছড়ি জেলা (মোট ৯ উপজেলা)
- মাটিরাঙ্গা – বাঙালি ৭৬%, আদিবাসী ২৪% = ৯৬,০০০
- মানিকছড়ি – বাঙালি ৭৪%, আদিবাসী ২৬% = ৫৭,০০০
- রামগড় – বাঙালি ৭৩%, আদিবাসী ২৭% = ৪৪,০০০
- খাগড়াছড়ি সদর – বাঙালি ৪১%, আদিবাসী ৫৯% = ১,৩৬,০০০
- দীঘিনালা – বাঙালি ৩৯%, আদিবাসী ৬১% = ৬২,০০০
- মহালছড়ি – বাঙালি ৩৭%, আদিবাসী ৬৩% = ১৮,০০০
- গুঁইমারা – বাঙালি ৩৬%, আদিবাসী ৬৪% = ১৯,০০০
- পানছড়ি – বাঙালি ৩৩%, আদিবাসী ৬৭% = ২৩,০০০
- লক্ষীছড়ি – বাঙালি ২৬%, আদিবাসী ৭৪% = ৭,০০০
রাঙামাটি জেলা (মোট ১০ উপজেলা)
- লংগদু – বাঙালি ৮১%, আদিবাসী ১৯% = ৯০,০০০
- কাপ্তাই – বাঙালি ৫৬%, আদিবাসী ৪৪% = ৫৫,০০০
- রাঙামাটি সদর – বাঙালি ৫২%, আদিবাসী ৪৮% = ১,৪৭,০০০
- কাউখালি – বাঙালি ৪৫%, আদিবাসী ৫৫% = ৬৬,০০০
- বরকল – বাঙালি ৪২%, আদিবাসী ৫৮% = ৫০,০০০
- বাঘাইছড়ি – বাঙালি ৪০%, আদিবাসী ৬০% = ১,০৬,০০০
- রাজস্থলী – বাঙালি ৩৮%, আদিবাসী ৬২% = ২৮,০০০
- বিলাইছড়ি – বাঙালি ৩৬%, আদিবাসী ৬৪% = ৩০,০০০
- জুরাছড়ি – বাঙালি ৩০%, আদিবাসী ৭০% = ২৭,০০০
- নানিয়ারচর – বাঙালি ২৮%, আদিবাসী ৭২% = ৪৯,০০০
বান্দরবান জেলা (মোট ৭ উপজেলা)
- নাইক্ষ্যংছড়ি – বাঙালি ৮৩%, আদিবাসী ১৭% = ৬৪,০০০
- লামা – বাঙালি ৭৬%, আদিবাসী ২৪% = ১,১৩,০০০
- বান্দরবান সদর – বাঙালি ৫৭%, আদিবাসী ৪৩% = ১,১১,০০০
- আলীকদম – বাঙালি ২৮%, আদিবাসী ৭২% = ৩৯,০০০
- রুমা – বাঙালি ৩৪%, আদিবাসী ৬৬% = ৪,২০০
- থানছি – বাঙালি ৩১%, আদিবাসী ৬৯% = ৩,৭০০
- বোয়াংছড়ি (রোয়াংছড়ি) – বাঙালি ৩০%, আদিবাসী ৭০% = ২,৯০০
এখন যদি নতুন আসনের সীমারেখা এমনভাবে টানা হয় যাতে বাঙালি-মেজরিটি এলাকাগুলো একত্রিত হয় এবং আদিবাসী-মেজরিটি এলাকাগুলো ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে এটি কেবল প্রতিনিধিত্ব নয়, গেরিম্যান্ডারিং—ভোটের অঙ্ক ঠিক করার খেলা।
নিরাপত্তা নাকি প্রি-এম্পটিভ কৌশল?
বাংলাদেশের থিংকথ্যাঙ্ক কি ভয়ে কাঁপছে?
রাশিয়া যুদ্ধ জয়ের কথা কি তাদের ভাবিয়ে তুলছে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আলাদা হয়ে যাবে? অধিকার যদি না দেন তাহলে এই পন্থাও কাজ দেবে বলে আমি মনে করি না।
হ্যাঁ, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থার কাছে পাহাড় সবসময় সংবেদনশীল। সশস্ত্র কার্যকলাপ, সীমান্তঘেঁষা অবস্থান এবং বহিরাগত স্বার্থ—সব মিলিয়ে এখানে সন্দেহের ছায়া ঘন। কিন্তু নিরাপত্তা তো এত বছর রাজনৈতিক নিপীড়ন রূপ নিয়ে বসে আছে। আসনে বাড়িয়ে কি হবে?
কাল যদি কেউ পাহাড়ে আলাদা রাষ্ট্রের দাবি তোলা হয়, তখন কি বলা হবে, “এই এলাকায় বাঙালি বেশি, তাই বাংলাদেশে থাকবে”?
সেই কথা ভাবছেন, তাই না?
কে প্রতিনিধিত্ব করবে?
এই স্মারকলিপি কারা দিল? পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি।
সব তো সেটলার সংগঠন। সেনা-পরিচালিত সংগঠন।
কিন্তু আদিবাসী সাধারণ জনগণ কোথায়?
আদিবাসী জনগোষ্ঠী- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, বম—তাদের কণ্ঠ কোথায়? সংসদীয় আসন বাড়লে তারা কি সুযোগ পাবে, নাকি বড় দলগুলো আবারও প্রধান দলগুলির (বিএনপি, জামাত,) হাতে নেতৃত্ব রাখবে?
গোপন অঙ্ক কী হতে পারে?
- রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: আসন সংখ্যা বাড়লে ক্ষমতার বণ্টন বদলাবে। যারা সীমান্ত-ঘেঁষা বাঙালি এলাকায় বসবাস করে, তাদের প্রভাব বাড়বে।
- নিরাপত্তা যুক্তি ব্যবহার করে সীমানা টানা: নিরাপত্তার নামে সীমারেখা প্রায়ই জনগোষ্ঠীর কণ্ঠ দমন করে।
- বিভক্তি ও প্রতিরোধ ভাঙা: আদিবাসী নেতৃত্ব বিভক্ত হলে আন্দোলনের শক্তি কমে।
- সংঘর্ষঃ পাহাড়ে আদিবাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ বেড়ে যাবে।
পাহাড়ের মানুষের জন্য করণীয় কী?
- আগে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হোক।
- জনশুনানি চাই: প্রতিটি জেলার মানুষকে ডাকা হোক, মতামত নেয়া হোক।
- ডেটা প্রকাশ: উপজেলা, ইউনিয়নভিত্তিক জনসংখ্যার তথ্য, ভোটার তালিকা উন্মুক্ত করা হোক।
- স্বাধীন কমিশন: রাজনৈতিক বা সেনা-নিয়ন্ত্রিত নয়, নিরপেক্ষ দল ডেলিমিটেশন করুক।
- সংখ্যালঘু কণ্ঠের সুরক্ষা: প্রয়োজনে সংরক্ষিত বা ঘূর্ণায়মান আসন চালু হোক, যাতে আদিবাসী নেতৃত্বে আসতে পারে।
ভাবুন
প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো দরকার—এ নিয়ে দ্বিমত নেই। পাহাড়ের উন্নয়ন, সেবা, গণতন্ত্রের জন্য বেশি আসন যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সীমারেখা যদি জনগণের প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে রাজনৈতিক লাভের হিসাব মেলাতে আঁকা হয়, তাহলে এটি হবে নতুন ষড়যন্ত্র। নিরাপত্তা বা উন্নয়নের নামে পাহাড়ের কণ্ঠ রোধ করা চলবে না।
সেটলার এবং সেনাদের ইচ্ছেঅনুসারে পাহাড় চলতে পারে না। এখানে আদিবাসী মানুষের সমর্থন দরকার। আগে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হোক, তারপর নাকি আসন নিয়ে ভাবা যাবে।
চুক্তি আগে বাস্তবায়ন হোক। তার আগে নয়। পাহাড় মানে শুধু জমি নয়, মানুষ; মানুষ মানে কণ্ঠ।
হ্যাঁ, সংসদীয় আসন বাড়ুক, কিন্তু ন্যায়ের পথে, স্বচ্ছ আলোচনায়, জনগণের সম্মতিতে। সেনারা বা রাষ্ট্র যদি এই আলোচনাকে গোপন খেলায় রূপ দেয়, পাহাড়ের মানুষ তা বোঝে এবং প্রশ্ন তোলে—“এরা কারা? কোন জনগণের প্রতিনিধি?”
বিদ্রঃ পোস্ট এখনো শেষ হয় নি। কিছু সংশোধন চলতে থাকবে।