মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু ছবি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে আমাদের চোখ আটকে যায়। এক মুহূর্তের জন্য থেমে ভাবতে বাধ্য করে, “এরা পারল, আমরা কেন পারছি না?”

মিজোরামের একটি ছোট দোকানের ছবি এমনই এক উদাহরণ। কোনো দোকানদার নেই, শুধু ফলমূল সুন্দর করে সাজানো। পাশে বোর্ডে দাম লেখা। মানুষ আসে, জিনিস নেয়, নির্ধারিত টাকা রেখে যায়। দোকানদার না থাকলেও কারও মনে একটুও চুরি করার বাসনা জাগে না।

এমন ঘটনা একবার নয়, বহুবার ঘটেছে। মিজোরামের ভাইরাল ছবিগুলোর মধ্যে দেখা যায় লম্বা ট্রাফিক লাইন। রাস্তা খালি, তবুও কেউ ওভারটেক করছে না। কেউ আইন ভাঙছে না। দেখানোর জন্য নয়, ক্যামেরার সামনে অভিনয় নয়, এটা তাদের স্বভাব। সততা যেন তাদের সংস্কৃতির অংশ।

এই ছবিগুলো দেখলে আমার মনে পড়ে জাপানের কথা। এখানে যদি কেউ চাবি হারায়, মানুষ তা পুলিশ পোস্টে জমা দেয়। হারানো টাকা, নথি—সবকিছু সেখানে রাখা হয়। যে হারিয়েছে সে খুঁজতে গেলে, পুলিশ থেকে সহজেই ফেরত পায়। সততা এখানে বিলাসিতা নয়, স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অংশ।

এমন সময় প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের পাহাড়ি সমাজে কী হলো? আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? আমাদের ইতিহাস কি এতটাই ভিন্ন?

কাপ্তেইন লুইনের পাহাড়ি দিনগুলো

ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন কাপ্তেইন লুইন। তার সময়ের চাকমারা কেমন ছিল? ইতিহাস বলে, চাকমারা স্বভাবতই আত্মমর্যাদাশীল, পরিশ্রমী এবং সম্মানপ্রিয় ছিল। সততা ও সাহসের জন্য পাহাড়ি সমাজ একসময় গর্বিত ছিল।

পাহাড়ি সমাজ অনেগুলো আদিবাসী গোষ্ঠী নিয়ে সুন্দর এবং সন্মানের ছিল। এমন কি ব্রিটিশ পর্যন্ত এই পাহাড়ি সমাজকে সততার কারণে সম্মান করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই শক্তি কোথায় হারাল?

আজকের দিনে পাহাড়ের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। রাজনীতি দুর্বল, সমাজ বিভক্ত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা তো দূরের কথা, আমরা নিজেদের স্বার্থে চুপ থাকি। রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি অন্ধ আনুগত্য, ধর্মীয় বিভাজন, সামাজিক বৈষম্য—সব মিলিয়ে পাহাড়ি সমাজ যেন ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত নীরবতায় ঢেকে গেছে।

ধর্মীয় শ্রেণির অন্ধত্ব

পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্মের দুটি ধারা—পার্বত্য ভিক্ষু এবং বন ভিক্ষু। নামের ভিন্নতা থাকলেও সমস্যা এক। তারা মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা দান গ্রহণ করে, কিন্তু সমাজে তার কতটুকু ফিরে আসে?

অনাথ শিশুদের জন্য ঘর কোথায়? পাহাড়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের অবদান কতটুকু?

সাধারণ মানুষের দুর্দশায়, অধিকার হারানোর যুদ্ধে তারা কোথায়?

বরং আমরা দেখি, দান-দক্ষিণা গ্রহণের উৎসব, আচার-অনুষ্ঠানের বাহুল্য, কিন্তু সমাজের মূল সমস্যাগুলো অন্ধকারেই রয়ে যায়। তারা শুধু পরজন্মের স্বপ্ন দেখায়, অথচ বর্তমানের ক্ষুধা, বঞ্চনা, অশিক্ষা তাদের আলোচনায় আসে না।

এই সমালোচনা বৌদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। বরং এটি ভালোবাসার সমালোচনা। কারণ ধর্ম তখনই শক্তি হয়, যখন তা মানুষের জীবনে আলো জ্বালায়। একটি জাতি স্বাধীন হলেও, যদি ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হতে না পারে, তবে সেই জাতি এগোতে পারে না।

পাহাড়ের আয়নায় মিজোদের প্রতিচ্ছবি

মিজোরা ভারতে অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের সমাজের ভিত মজবুত। তারা যা ভালো, তা গ্রহণ করে। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না। তাদের জীবনে সততা ও শৃঙ্খলা শুধু আইন নয়, অভ্যাস। অথচ আমরা, পাহাড়ের মানুষ, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করি, ভয় করি, চুপ থাকি।

আজ পাহাড়ে ভাইয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ প্রায় শেষ। অধিকারও হয়তো এসে যাবে।হয়তো শীঘ্রই তা আমরা বুঝতে পারবো। ইঙ্গিত পাবো অধিকার আসছে। একদিন পুরো এসে দরজায় হাজির হবে।

কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। সমাজের ভেতরের অন্ধকার—অজ্ঞতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক উদাসীনতা—এসব না বদলালে মুক্তি মিলবে না।

ভাবুন তো, যদি আজকের মিজোরা পাহাড়ে থাকত, তারা কী করত? তারা হয়তো আইন মেনে চলত, সততাকে প্রাধান্য দিত, অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক হতো। তাদের দেখানো পথ আমাদের জন্য আয়না হতে পারত।

প্রয়োজন নতুন ধর্মনীতি ও বাস্তববাদী দৃষ্টি

আজ পাহাড়ে দরকার বৌধিচারিয়া মঠের মতো বাস্তবমুখী ধর্মনীতি, যেখানে অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রয় থাকবে, শিক্ষার আলো পৌঁছাবে প্রত্যন্ত গ্রামে, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াবে ভিক্ষু সম্প্রদায়। ধর্ম মানে শুধু আচার-অনুষ্ঠান নয়, ধর্ম মানে সমাজের জন্য কাজ করা।

ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করতে হবে। সমাজের মানুষ সবায় ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত সমাজ চায় কিন্তু সেভাবে কাজ করে না। কথার সাথে কাজের মিল নেই। সবায় বৌধিচারিয়ার মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কিন্তু সেরকম প্রতিষ্ঠানের মত প্রতিষ্ঠান গঠনের চেষ্টা না করে আমরা সমস্ত টাকা-পয়সা সে বনদের দান করে দিই।

আসলে সমাজের মানুষকে বনদের এড়িয়ে চলতে হবে। এই এড়িয়ে চলা কাজটা শুধু ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত যুব সমাজের কাজ নয়, এটা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। তাদের নীতি সংস্কার করতে হবে না হয় এদের এড়িয়ে চলতে হবে। এই বনদের উৎপত্তি থেকে আজ পর্যন্ত সমাজের জন্য কি হয়েছে তা যদি সমাজের প্রতিটি সচেতন মানুষ বিশ্লেষণ করতে না পারে এই গৃহযুদ্ধের মত আরও অনেক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ দেখবে।

ভাবছেন, বর্তমান গৃহযুদ্ধ ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নয়? পুরোপুরি হয়তো নয়, কিন্তু তার প্রভাব তো আছে। সেই যুক্তিতে আজ যাবো না। অন্যদিন ফিরে আসবো সে বিষয়ে।

আমরা চাই নতুন প্রজন্মকে এমন এক পথ দেখাতে যেখানে সততা, শৃঙ্খলা, আত্মসম্মান সবচেয়ে বড় পরিচয় হবে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রয়োজন, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। অভ্যন্তরীণ শক্তি না থাকলে পাহাড় শুধু মানচিত্রে টিকে থাকবে, কিন্তু হৃদয়ে বাঁচবে না।

শেষ করতে চাই না

এখানে শেষ করতে চাচ্ছি না। কিন্তু শেষ তো করতে হবে কারণ অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে।

আজ সময় এসেছে আঙুল তোলার বদলে আয়নায় তাকানোর। আমরা অন্যের অন্যায় দেখি, কিন্তু নিজেদের ভুলের দিকে কি নজর দিই? সমাজের ধর্মীয় শ্রেণি, রাজনৈতিক নেতা, সাধারণ মানুষ—সবাই মিলে কি একবার ভাবতে পারি, “আমরা কি সৎ? আমরা কি দায়বদ্ধ?”

মিজোদের ছবি আমাদের সামনে আয়নার মতো। তারা দেখিয়ে দিয়েছে, ছোট একটি সমাজও যদি সততা আর শৃঙ্খলাকে আঁকড়ে ধরে, তবে তারা অনুপ্রেরণার গল্প হতে পারে। আমরা কি প্রস্তুত নিজেদের সেই পথে নিয়ে যেতে?

পরিশেষে একটু যোগ করে দিই, ব্রিটিশ আমলে চাকমারা যখন শত শত শিক্ষিত তখনো মিজোরা পানি নাকি পেট্রোল চিনত না। আজ তারা দেশ চালায়, বিমান চালায়, ইসরায়েলে যুদ্ধবিমান চালায়, রকেট নিয়ন্ত্রণ করে। সারা বিশ্বে মিজো পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথে তাদের সততার বিষয়ে কোন প্রশ্ন করা হয় না সেখানে আজ আমরা অধিকারহীন এক রাজ্যহীন এক যাযাবর জাতি।

তাই আমাদের ভাবতে হবে। ভ্রাত্রিঘাতি সংঘাত সাথে ধর্মীয় এবং সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়গুলো সংস্কার করতে হবে। যদি পারি , আমরা কিন্তু মিজোদের চেয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবো। কারণ দুর্নীতি, সততা এবং অনৈক্য বাদ দিলে আমাদের অন্য পয়েন্টগুলো অনেক বেশী অগ্রগামী।