ভিয়েতনামের কথা আমরা কম বেশী জানি। অনেক সময় এই দেশের বীরত্ব আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে সেই রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে ধর্মীয় সংস্কারের কিছু কথা লিখবো। কাউকে দোষারোপ করার জন্য নয় বরং অনুপ্রেরণা এবং সাহস দেওয়ার জন্য।
ভিয়েতনামের ইতিহাস রক্তে ভিজে আছে। যুদ্ধ, বিদেশি দখল, দারিদ্র্য আর শরণার্থীর জীবন মিলেমিশে সেখানে ধর্মকে অনেক সময় শুধু মন্দিরের দেয়ালের ভেতরে আটকে রেখেছিল। ভিক্ষুরা আচার-অনুষ্ঠান করত, মন্ত্রপাঠ আর ধ্যানে ডুবে থাকত, কিন্তু মন্দিরের বাইরের জগতে যে মানুষ ক্ষুধায় কাতর, ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের জীবনে ধর্মের কোনো কার্যকর ভূমিকা ছিল না।
এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ভিক্ষু—থিচ ন্যাত হান। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন, যদি ধর্ম মানুষের দুঃখ ভাগ না করে নিতে পারে, তবে সেটি কেবল আচার আর প্রথা মাত্র। যখন গ্রাম জ্বলছে, মানুষ রক্তে ভেসে যাচ্ছে, তখন কেবল ধূপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করলে শান্তি আসবে না। তখন দরকার এমন এক ধর্মের, যা মানুষের পাশে দাঁড়াবে, তাদের ক্ষুধা নিবারণ করবে, আশ্রয় দেবে এবং ক্ষতবিক্ষত শরীরে মলম বুলিয়ে দেবে। এই উপলব্ধি থেকেই জন্ম নিল “এনগেজড বৌদ্ধধর্ম”—যেখানে ধর্ম আর নিছক ধ্যান বা মন্ত্রপাঠে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সমাজের সক্রিয় অংশ হয়ে ওঠে।
থিচ ন্যাত হান ভিক্ষুদের ডেকে বললেন—ধ্যান মানে শুধু চোখ বন্ধ করা নয়, বরং সমাজের চোখ খোলা। তিনি আহ্বান জানালেন—মন্দির থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে, ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে, আর প্রার্থনার সাথে মিশিয়ে দিতে শিক্ষা, শ্রম আর ভালোবাসা।
তাঁর নেতৃত্বে ভিক্ষুরা স্কুল গড়ে তুলল যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুদের জন্য, কৃষকের সাথে মাঠে নেমে ধান রোপণ করল, শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও ওষুধের ব্যবস্থা করল, এমনকি শান্তির মিছিলেও অংশ নিল। ধর্ম তখন আর নিছক আধ্যাত্মিক অনুশীলন নয়, বরং জীবন্ত সমাজের আন্দোলনে রূপান্তরিত হলো।
ভিয়েতনামের মাটিতে তখন যুদ্ধের আগুন। একদিকে মার্কিন সেনারা বোমা বর্ষণ করছে, অন্যদিকে বিদ্রোহীরা লড়ছে। এই দুই শক্তির সংঘাতে সাধারণ মানুষ হচ্ছিল সবচেয়ে বড় ভিকটিম। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে থিচ ন্যাত হানের নেতৃত্বে ভিক্ষুরা আশ্রয়কেন্দ্র বানাল, যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা করল, ক্ষুধার্তদের খাবার দিল।
ভিয়েতনামের মানুষ দেখল এক নতুন চিত্র—ভিক্ষুরা আর কেবল ভিক্ষার থালা নিয়ে গ্রামে যাচ্ছে না, বরং হাতে বই নিয়ে শিশুদের পড়াচ্ছে, কৃষকের কাঁধে হাত রেখে জমিতে নেমেছে, নারীদের সংগঠিত করছে। ধর্ম তখন মানুষকে শোষণ করছে না, বরং মুক্তি দিচ্ছে।
থিচ ন্যাত হানের এই আন্দোলন মানুষকে নতুন করে ভাবতে শিখাল। তিনি বললেন, ধর্ম মানে কেবল দান সংগ্রহ নয়, ধর্ম মানে সেবা। যদি মন্দির শুধু সোনার মূর্তি দিয়ে সাজানো থাকে, কিন্তু গ্রামের মানুষ ক্ষুধায় মরে, তবে সেই মন্দিরের কোনো মর্যাদা নেই।
হ্যাঁ, মর্যাদা তখনই আসবে যখন ধর্ম মানুষের জীবনের সাথে একীভূত হবে। তাঁর এই দর্শন ভিয়েতনামের সমাজকে নতুনভাবে গড়ে তুলল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও তাঁর শিক্ষা জীবিত রইল এবং আজও বিশ্বের নানা প্রান্তে শান্তি, মানবাধিকার আর সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।
আজ যখন আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে তাকাই, তখন একই প্রশ্ন জেগে ওঠে। ভিক্ষুরা অনেক সময় “ত্যাগ” বা “দান”-এর নামে সাধারণ মানুষের উপর বোঝা চাপিয়ে দেয়, অথচ গ্রামের দরিদ্র শিশুদের জন্য কোনো স্কুল বানায় না, অসুস্থদের জন্য ওষুধ আনে না, তরুণদের জন্য কোনো কাজের প্রশিক্ষণ দেয় না। ধর্ম যদি শুধু সংগ্রহ করে, আর মানুষের দুঃখে কোনো হাত না বাড়ায়, তবে সেই ধর্ম মৃত।
থিচ ন্যাত হান বিশ্বকে শিখিয়ে গেছেন, সংস্কার সম্ভব। পাহাড়ি ভিক্ষুরা যদি স্কুল গড়ে তোলে, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বানায়, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বই কিনে দেয়, পরিবারকে কাজ শেখায়, তবে তারা সত্যিকারের আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হবেন।
থিচ ন্যাত হান ছিলেন না কোনো সেনাপতি, ছিলেন না কোনো রাজা। তিনি ছিলেন এক শান্ত ভিক্ষু। কিন্তু তাঁর দর্শন ভিয়েতনামের ইতিহাসে নতুন আলো জ্বালিয়েছে। তিনি প্রমাণ করেছেন, ধর্ম যদি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে তবে তা নিছক আচার-অনুষ্ঠান, কিন্তু ধর্ম যদি মানুষের দুঃখ লাঘব করে, তবে তা জাতি গঠনের শক্তি হয়ে ওঠে।
আজ আমাদের পাহাড়ি সমাজ, তরুণ প্রজন্ম ও ধর্মীয় নেতৃত্ব তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তারা উপলব্ধি করতে পারবে, ধর্ম মানে শুধু মন্দিরে বসা নয়, ধর্ম মানে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। ধর্ম তখনই জীবন্ত হয়, যখন তা শোষণ ভেঙে মুক্তি আনে।