বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এমনভাবে মিলেছে যে মনে হয় ইতিহাস, বর্তমান আর রাজনীতি যেন একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয় করছে। একদিকে চীন সফরে, অন্যদিকে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকায়। দুটো ঘটনার টাইমিং এত সুন্দরভাবে মিলে গেছে যে সাধারণ মানুষও প্রশ্ন করছে—এ কি নিছক কাকতালীয়, নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনো কূটনৈতিক ইঙ্গিত?

সেনাপ্রধানের চীন সফর:

২১ আগস্ট ২০২৫ সকালে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান চীনে রওনা হন। সূচি অনুযায়ী তিনি ফিরবেন ২৭ আগস্ট। অর্থাৎ ক্যালেন্ডারে এটি একেবারে ৭ দিনের সফর। তবে সরকারি ভাষায় বলা হয়েছে “৪ দিনের অফিসিয়াল ভিজিট।” কেন? আসলে নির্দিষ্ট বৈঠক, আলোচনার দিন গোনা হয়েছে ৪টি, আর বাকি সময় ধরেছে যাতায়াত ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা।

এই সফরের লক্ষ্য একেবারেই স্পষ্ট—চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানো, সামরিক আধুনিকীকরণ ও প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করা, আর পারস্পরিক সৌজন্য সাক্ষাতের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ককে দৃঢ় করা।

পাকিস্তানের ইসহাক দার ঢাকায়: চুক্তির কাগজে অগ্রগতি

২৩ ও ২৪ আগস্ট পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকায় এলেন। সফরের ফলাফল হিসেবে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা অব্যাহতি, পাশাপাশি সংস্কৃতি, থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক, সংবাদ সংস্থা এবং ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি।

কিন্তু যখন উঠল ১৯৭১-এর প্রশ্ন—তখনই স্পষ্ট হলো যে দুই দেশের অবস্থান এখনো ভিন্ন। ইসহাক দার বললেন, “সব আগেই মীমাংসিত।” তিনি ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি আর ২০০২ সালের মোশাররফের সফরকে উল্লেখ করে ঢাকাকে “হৃদয় পরিষ্কার করার” উপদেশ দিলেন।

কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন একেবারেই অমত পোষণ করলেন। তিনি জানালেন, বাংলাদেশের কাছে এই ইতিহাস এখনো অমীমাংসিত। অর্থাৎ ব্যবহারিক সম্পর্ক যতই এগোক, নৈতিক ইস্যুটি অটলভাবে রয়ে যাচ্ছে।

এটা কি শুধু দেশের মানুষকে শান্ত রাখার জন্যে নাকি সরকারের হৃদয়ের বক্তব্য?

তবে অনেকে বলছে, বর্তমান সরকারের নীতি দেখে আপাতত তা মনে হয় না। দেশের মানুষকে শান্ত রাখতেই নাকি এই ৭১-এর বিষয়টি আনা হয়েছে এবং পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলা হচ্ছে।

টাইমিং কেন এভাবে মিলল?

কূটনৈতিক সফরগুলো আগে থেকেই ঠিক হয়, তাই এটিকে নিছক কাকতাল বলা যায়। কিন্তু একই সময়ে দুই ভিন্ন দিকের বড় পদক্ষেপ মিল খাওয়ায় মানুষের মনে প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক।

একদিকে চীনের সঙ্গে সামরিক ট্র্যাক, অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে ভিসা-চুক্তি—দুটো ঘটনাই বাংলাদেশকে একধরনের মাল্টিভেক্টর কূটনীতি”-র ইঙ্গিত দেয়। মানে, একসাথে একাধিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা।

গোলাম আজম: ইতিহাসের ভূত বারবার ফিরে আসে

বাংলাদেশ–পাকিস্তান সম্পর্ক উঠলেই এক নাম বারবার ফিরে আসে—গোলাম আজম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, তিনি ‘পিস কমিটি’ গঠনে ভূমিকা রাখেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করেন।

স্বাধীনতার পর তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল হয়। পরে পাকিস্তানে থেকে এবং লন্ডনে বসে তিনি “East Pakistan Retrieval Committee” ও Shonar Bangla নামের পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান।

১৯৭৮ সালে পাকিস্তানি পাসপোর্টে ট্যুরিস্ট ভিসায় দেশে ফিরে আসেন। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ১৯৯৪ সালে তিনি আবার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পান। এ ইতিহাসই আজও ঢাকার রাজনৈতিক আলোচনায় পাকিস্তানের প্রসঙ্গ এলেই সামনে চলে আসে।

তাঁর ছেলে: আব্দুল্লাহিল আমান আযমী

আমান আযমী একসময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ছিলেন। ২০০৯ সালে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। ২০১৬ সালে তিনি নিখোঁজ হন, পরে ২০২৪ সালে ফিরে আসেন।

সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তিনি জাতীয় সংগীত ও সংবিধান বদলানোর পরামর্শ দেন। জামায়াতে ইসলামী জানিয়ে দেয়—এটা দলের অবস্থান নয়, তাঁর ব্যক্তিগত মত।

বর্তমানে তিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত নন, অবসরপ্রাপ্ত। তবুও তাঁর নাম ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা গুজবের জন্ম দেয়। এবারও ব্যতিক্রম নয়। তার নাম শোনা যাচ্ছে।

সেনাপ্রধান বদল—আইন কী বলে

অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, সেনাপ্রধান কি বদল হতে যাচ্ছেন?

বাস্তবতা হলো, সেনাপ্রধান নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। সাধারণত কর্মরত সিনিয়র জেনারেলদের মধ্য থেকে, বিশেষ করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদা থেকে এ নিয়োগ হয়। অবসরপ্রাপ্ত বা নিম্নপদমর্যাদা থেকে কাউকে বসানো আইনের বাইরে এবং নজিরবিহীন। তাই ফেসবুক বা টুইটারের গুজবকে সত্য ভাবার কোনো কারণ নেই।

আর যদি সত্যে হয়?

তাহলে বলব, বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। কিন্তু পরিণতি হয়তো ভিন্ন হতে পারে। বাংলাদেশ তাহলে পুরো ভিন্ন দিকে মোড় নিবে যা অনেকের মত আমিও ভাবতেও আতঙ্কিত হচ্ছি।

কারণ সেনাপ্রধান পরিবর্তনের গুঞ্জন নতুন নয়। সেই হাসানতের সাথে সেনানিবাসে সেনাপ্রধানের সাথে লিগ নিয়ে কথা কাটাকাটি থেকে আজ পর্যন্ত বিষয়টি ছোট করে দেখার অবকাশ ছিল না।

সীমান্তের আগুন: রাখাইন ও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ

বাংলাদেশের কূটনীতিকে প্রভাবিত করছে সীমান্তের ঘটনাও। মিয়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মি বড় এলাকা দখল করেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা টানা ৮ বছরে গড়াল। প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে আছে। ২ লক্ষ রোহিঙ্গা এখনো সীমানা পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার অপেক্ষায় আছে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সহায়তা দিন দিন কমে আসছে। সরকার প্রধান খোলাখুলি বলছেন—বাংলাদেশ আর একা এই বোঝা বহন করতে পারছে না। এদিকে সংবাদমাধ্যমে আসছে খবর, কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। তার মানে স্পষ্ট—বর্তমান বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে যেন একধরনের “যুদ্ধ সাজ সাজ রব”

এই অবস্থায় ঢাকা একদিকে চীন, ভারত ও পাকিস্তান—সব দিক সামলাতে চাইছে; অন্যদিকে সীমান্তের অস্থিরতা ও মানবিক চাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। আর ভেতরে ভেতরে চলছে সমীকরণের খেলা। সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগের আলোচনা ভেসে আসছে। কারণ যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বর্তমান সেনাপ্রধানের ভূমিকা নিয়ে সরকারের ভেতরেই দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

শেষকথা: উত্তর নয়, প্রশ্নই শক্তি

আমার কাছে আসল ব্যাপার হলো—এই ঘটনাগুলো উত্তর দেয়ার চেয়ে বেশি প্রশ্ন জাগায়।

  • ১৯৭১-এর দায় কি সত্যিই একদিন মিটবে?
  • চীন ট্র্যাক বাড়ালে ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন কি বাড়বে, নাকি ভারসাম্য রক্ষা হবে?
  • রাখাইনের আগুন বাংলাদেশকে আর কতটা পোড়াবে?
  • সেনাপ্রধান বিদেশে আর পাকিস্তানি নেতা ঢাকায়—এটা কি নিছক কাকতাল, নাকি বড় কোনো ইঙ্গিত?
  • গুজব না হয়ে যদি গুঞ্জন হয়, তাহলে কে হচ্ছেন সেনাপ্রধান?

রাজনীতির সৌন্দর্য এখানেই—সব প্রশ্নের উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে মেলে না। কিন্তু প্রশ্নগুলো করাই হলো গণতন্ত্র ও রাজনীতিকে জীবিত রাখার প্রথম ধাপ। আজ অনেকের মত আমিও প্রশ্ন রাখলাম। উত্তরগুলো সময়ের অপেক্ষায়।